শুক্রবার, ২৪ মার্চ ২০২৩, ০৯:৫৬ অপরাহ্ন

আধুনিক পদ্ধতিতে সূর্যমুখী চাষ

মৌমিতা আক্তার / ১১১ বার
আপডেট : বুধবার, ৬ জুলাই, ২০২২
আধুনিক_পদ্ধতিতে_সূর্যমুখী_চাষ

সূর্যমুখী সারা বিশ্বের হিসাবে তেল বীজ ফসলের মধ্যে সয়াবিনের পরেই সূর্যমুখীর স্থান। এ তেলবীজে ৪২-৪৫% তেল আছে। সূর্যমুখীর তেল অন্যান্য ফসলের তেলের চেয়ে অনেক উন্নতমানের। বিশেষ করে হৃদ রোগীদের জন্য এ তেল খুব উপকারী। নানা রকমের রান্নাবান্না ছাড়াও চিনাবাদামের মতো সূর্যমুখীর বীজ ভেজে খাওয়া যায়। এ তেলে মানুষের শরীরের জন্য উপকারী লিনোলিক এসিড (৫৫%) বেশি পরিমাণে থাকে এবং ক্ষতিকর ইরোসিক এসিড নাই। সূর্যমুখীর গাছ এবং পুষ্পস্তবক জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ ফসলের খৈল গবাদিপশু এবং হাস-মুরগির প্রিয় এবং পুষ্টিকর খাদ্য। সূর্যমুখী আলো ও তাপ সংবেদনশীল নয়, তাই সারা বছরই এ ফুলের চাষ করা যায়। বাংলাদেশের রাজশাহী, পাবনা, নাটোর, গাজীপুর, টাঙ্গাইলসহ বেশ কয়েকটি জেলায় বর্তমানে সূর্যমুখীর চাষ হচ্ছে। পৃথিবীর প্রধান প্রধান সূর্যমুখী চাষকারী দেশ হচ্ছে রাজশাহী, আর্জেন্টিনা, ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র।

আধুনিক_পদ্ধতিতে_সূর্যমুখী_চাষ

আধুনিক পদ্ধতিতে সূর্যমুখী চাষ:
১। মাটি নির্বাচন : প্রায় সব ধরনের মাটিতেই সূর্যমুখীর চাষ করা যায়। তবে উঁচু থেকে মাঝারি নিচু প্রকৃতির দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটি সূর্যমুখী চাষের জন্য উত্তম। জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় না এমন সুনিষ্কাশিত মাটি সূর্যমুখী চাষের জন উত্তম। সূর্যমুখী খরা ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু হওয়ায় বায়লাদেশের ববেন্দ্র অঞ্চল ও উপকূলীয় কিছূ এলঅকায় চাষ করা সম্ভব।

২। জাত নির্বাচন : সূর্যমুখীর অনেক জাত আছে। যেমন- ভিনিমিক ৬৫৪০, পেরোডমিক, আয়াক, জুপিটার, সানরাইজ ইত্যাদি। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কিরনী (ডি.এস-১) ও বারি সূর্যমুখী -২ নামক দুটি জাত উদ্ভাবন করেছে। জাতটি অপেক্ষাকৃত খাটো বলে ঝড় বৃষ্টিতে সহজে হেলে পড়ে না। এ জাত আমাদের দেশের জন্য ভালো। গাছের উচ্চতা ৯০-১১০সে.মি, বীজ লম্বা, চ্যাপ্টা ও কালো এবং বীজে তেলের পরিমাণ ৪২-৪৪%। জাতটি আলো নিরপেক্ষ, অল্টার নেরিয়া রোগ প্রতিরোধী। গাছের জীবনকাল ৯০-১১০ দিন। ফলন ১.৬-১.৮ টন/হেক্টর।

৩। জমি তৈরি : সূর্যমুখী একটি গভীরমূলী ফসল। তাই শিকড়ের বিস্তৃতি যাতে সঠিকভাবে হতে পারে তার জন্য জমি গভীর করে চাষ করতে হয়। সাধারণত ৪-৫টি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝরা ও উপরিভাগ সমান করেনিতে হয় । মাটিতে হেক্টরপ্রতি ১৫ টন গোবর সার দিতে হবে।

৪। সার প্রয়োগ : সূর্যমুখী চাষে হেক্টর প্রতি রাসায়নিক মাত্রা : সারের নাম ও পরিমাণ
হেক্টর প্রতি ১৮০-২০০ কেজি ইউরিয়া, ১৬০-১৮০ কেজি টিএসপি , ১৫০-১৭০ কেজি এমপি, ১০-১২ কেজি বোরন, ৮-১০ কেজি দস্তা।
ইউরিয়ার অর্ধেক এবং অন্যান্য সার পুরোটাই শেষ চাষের সময় মাটিতে ছিটিয়ে মিশিয়ে দিতে হয়। বাকা ইউরিয়ার দুই ভাগের এক ভাগ চারা গজানোর ২০-২৫ দিন পর একবার এবং শেষ ভাগ ৪০-৪৫ দিন পর ফুল ফোটার আগে প্রয়োগ করতে হয়।

৫। বীজ বপন সময় : সূর্যমুখী সারা বছরই চাষ করা যায়। খরিফ মৌসুমে চৈত্র-বৈশাখ মাসে এবং রবি মৌসুমে কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে বীজ বপন করতে হয়। সাধারণত হেক্টরপ্রতি ১০-১২ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। তবে হাইব্রিড জাতের বীজ ছোট হওয়ায় হেক্টরে ৬-৮ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়।

৬। বীজ বপন পদ্ধতি ও বীজ শোধন : এ ফসলের বীজ সারিতে বপন করা উত্তম। কারণ এতে বিভিন্ন পরিচর্যা করা সহজ হয় এবং ফলনও ভালো হয়। সারি থেকে সারির দূরত্ব ৪০-৬০ সেমি এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ২০-২৫ সেমি হওয়া বাঞ্ছনীয়। বীজগুলো বপনের পূর্বে ৪-৫ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখলে বীজের অঙ্কুরোদগম ভালো হয়। মাটি ও বীজবাহিত রোগ এড়ানোর জন্য প্রতি কেজি বীজ ৩ গ্রাম ভিটাভেক্স-২০০ দ্বারা শোধন করে নিতে হয়। প্রতি গর্তে দুটি করে বীজ মাটির ২-৩ সে.মি. গভীরে পুতে দিতে হয়।
৭। আগাছা দমন ও চারা পাতলাকরণ : যতদিন ফসল দ্বারা জমি ঢেকে না যায়, ততদিন প্রয়োজনমতো আগাছা দমনের ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া বীজ গজিয়ে চারা শক্ত হবার পর সবল চারাটি রেখে বাকি চারা গুলো তুলে ফেলতে হয়। আবার কোনো সারিতে চারা না গজালে অন্য জায়গার চারা এনে ঐ স্থান পূরণ করতে হয়।

৮। সেচ ও নিকাশ : চারা রোপণের পর এবং জমিতে রসের অভাব হলেই সেচ দিতে হব। খরিপ মৌসুমে ঠিকমতো প্রথম সেচ- বীজ বপনের ৩০ দিন পর অর্থাৎ ফুল আসার আগে, দ্বিতীয় সেচ- বীজ বপনের ৫০ দিন পর অর্থাৎ পুষ্পস্তবক তৈরির সময় এবং তৃতীয় সেচ- বীজ বপনের ৭০ দিন পর (বীজ পুষ্ট হবার আগে) দিতে হবে। তাছাড়া বৃষ্টির বা অতিরিক্ত সেচের কারণে পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হলে সে পানিনিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।

৯। গাছ বেঁধে দেয়া : ফুল আসার পর সূর্যমুখী গাছ ভারী হয়। তাই গাছ যাতে হেলে পড়ে না যায়, তার জন্য সময়মতো বাশেঁর কাঠি পুতে গাছে বেঁধে দিতে হবে। বিশেষ করে খরিপ মৌসুমের চাষে খুঁটি বাঁধা বেশি প্রয়োজন। কারণ এ সময় ঝড় বৃষ্টির সম্ভাবনা বেশি থাকে।

১০। সূর্যমুখীর ক্ষেতে মৌ বাক্স স্থাপন : সূর্যমুখীর ফলন বৃদ্ধির জন্য ফুল ফোটার সাথে সাথে জমিতে কৃত্রিম মৌ বাক্স স্থাপন করা দরকার। যেহেতু সূর্যমুখী একটি পরপরাগায়িত শস্য, সেহেতু পর্যাপ্ত পরিমাণে মৌমাছি না থাকলে পরাগায়নে ব্যাঘাত ঘটে এবং ফলন কমে যায়। জমিতে মৌ বাক্স স্থাপন করলে একদিকে যেমন সূর্যমুখী ফলন বৃদ্ধি পাবে অন্যদিকে বাক্স থেকে খাঁটি মধু সংগ্রহ করা যাবে।

১১। পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন : এ ফসলে রোগ ও পোকার আক্রমণ খুব কম হয়। তবে কোনো কোনো সময় বিছাপোকার আক্রমণ হলে রিপকর্ড ১০-ইসি, সিমবুশ-১০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলিলিটার হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
সূর্যমুখীর রোগের মধ্যে পাতায় দাগপড়া ও গোড়া পচা রোগটি উল্লেখযোগ্য। একজাতীয় বীজবাহিত ছত্রাকের দ্বারা রোগটি হয়। দাগ পড়া রোগে প্রথমে পাতায় ধূসর বা গাঢ় বাদামি বর্ণের অসম আকৃতির অসংখ্য দাগ পড়ে। এ দাগগুলো আস্তে আস্তে একত্রে মিলিত হয়ে বড় দাগের সৃষ্টি করে। রোগ তীব্র হলে সম্পূর্ণ পাতা ঝলসে যায় বা কালো হয়। শিকড় পচা রোগে আক্রন্ত গাছের শিকড়ে সাদা তুলার মতো ছত্রাকের মাইসেলিয়াম দেখা যায়। প্রথম পর্যয়ে গাছ কিছূটা নেতিয়ে পড়ে। দুই তিন দিনের মধ্যে সমস্ত গাছ ঢলে পড়ে এবং শুকিয়ে মারা যায়।

রোগের প্রতিকার:
(১) রোগ সহনশীল জাতের সূর্যমুখী চাষ করতে হেব। যেমন- কিরনী।
(২) শস্য পর্যায় অবলম্বন করতে হবে।
(৩) ফসল কাটার পর গাছের পরিত্যক্ত অংশ যেমন- কাণ্ড, মূল, পাতা নষ্ট করে ফেলতে হবে।
(৪) পেনকোজেব-৮০ ডব্লিউপি বা রিডোমিল এমজেড-৭২ বা ডাইথেন এম-৪৫ প্রতি লিটার পানির সাথে ২ গ্রামে ১০ দিন পরপর মোট তিনবার স্প্রে করতে হবে।
(৫) বীজ বপনের পূর্বে ভিটাভেক্স -২০০ দ্বারা বীজ শোধন করে নিতে হবে।

১২। পাখি তাড়ানো : বীজ পুষ্ট হওয়া শুরু হলে জমিতে টিয়া পাখির উপদ্রব শরু হয়। খুব ভোরে এবং সন্ধ্যার পূর্বে পাখির আক্রমণ বেশি হয়। তাই বীজ পুষ্ট হওয়া থেকে শরু করে ফসল কাটা পর্যন্ত পাখি তাড়ানোর ব্যবস্থ করতে হবে। ঘণ্টা বাজিয়ে অথবা জমির মাঝে টিন বেঁধে রশির সাহায্যে দূর থেকে টেনে শব্দ করলে পাখি বসতে পারে না।

১৩। ফসল কাটা : মৌসুমভেদে সূর্যমুখী ফসল পাকতে ৯০ থেকে ১২০ দিন সময় লাগে। ফসল কাটার সময় হলে ফুলের পিছনের দিক বাদামি ও গাছের পাতা হলুদ হয়ে আসে এবং মাথা নুইয়ে পড়ে। দানাগুলো পুষ্ট ও শক্ত হয় এবং কালো রং ধারণ করে। কাটার উপযোগী হলে ধারালো কাচি দ্বারা পুষ্প স্তবক কেটে কয়েক দিন স্তূপ করে রাখার পর ২-৩ দিন রোদে শুকিয়ে নিতে হবে।

১৪। মাড়াই ও গুদামজাত করা : সূর্যমুখীর পুষ্প স্তবক ভালোভাবে শুকানোর পর লাঠির সাহায্যে পিটিয়ে বীজ আলাদা করা হয়। এরপর ভালোভাবে পরিষ্কার করে বীজগুলো ৪-৫ দিন রোদে শুকিয়ে বায়ুরোধী পূলিব্যাগে বা ড্রামে সংরক্ষণ করা যায়। বীজ সংরক্ষণের আগে গুদাম ঘরটি ওষুধ দ্বারা শোধন করে নেয়া ভালো।

এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পূর্ন বেআইনী এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। হিমেল/বিডি দিগন্ত


এ জাতীয় আরো সংবাদ