শনিবার, ২৫ মার্চ ২০২৩, ১২:৩৮ অপরাহ্ন

সয়াবিনের আধুনিক চাষ পদ্ধতি

হিমেল খন্দকার / ১০৩ বার
আপডেট : বুধবার, ৬ জুলাই, ২০২২
সয়াবিনের_আধুনিক_চাষ_পদ্ধতি

সয়াবিন তেলবীজ ফসল হিসেবে সয়াবিন বিশ্বে প্রথম স্থানের অধিকারী। সয়াবিনে রয়েছে জাতভেছে শতকরা ১৯-২২ ভাগ তেল এবং ৪০-৪৫ ভাগ আমিষ। অন্যান্য ডাল ও শুটিজাতীয় শস্যের তুলনায় সয়াবিন দামের প্রায় অর্ধেক। আমাদের খাদ্য তালিকায় সয়াবিন অন্তর্ভুক্ত করে এ দেশের জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশকে অপুষ্টির হাত থেকে রক্ষা করা যেতে পারে। বাংলাদেশে সয়াবিন একটি নতুন ফসল। তেল নিষ্কাশনের কোনো পর্যাপ্ত ও সঠিক ব্যবস্থা না থাকায় এদেশে এখনো সয়াবিনের চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি।

সয়াবিনের আধুনিক চাষ পদ্ধতি :

১। মাটি ও আবহাওয়া : সয়াবিন দোআঁশ, বেলে দোআঁশ ও এঁটেল দোআঁশ মাটিতে চাষ করা যায়। আমাদের দেশের মাটি ও আবহাওয়ায় রবি এবং খরিফ উভয় মৌসুমই সয়াবিন চাষ করার উপযোগী। খরিফ বা বর্ষা মৌসুমে চাষের জন্য জমি অবশ্যই উঁচু ও পানি নিষ্কাশনযোগ্য হতে হবে। রবি মৌসুমে মাঝারি থেকে নিচু জমিতে ও সয়াবিন চাষ করা যায়। সয়াবিন কম বা বেশি তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে না। মাটির অম্লমান ৬.৫-৭.৫ এর চাষের জন্য উত্তম।

২। জাত : বাংলাদেশ সয়াবিন-৪(জি-২), বারি ৫ ও ৬, বিনা ১ ও ২, ব্রাগ, ডেভিস এবং পিভি-১ অনুমোদিত সয়াবিনের জাত। সয়াবিনের জাতগুলোর বৈশিষ্ট্য নিচে উল্লেখ করা হলো :

ক. ব্রাগ : এ জাতের সয়াবিন বছরে তিনবার চাষ করা যায়। মৌসুমভেদে বীজ বপনের ১০০-১১০ দিনের মধ্যে গুটি পাকে। আখের সাথে সাথী ফসল হিসাবে এ জাত চাষের উপযোগী। অনুকূল আবহাওয়ায় হেক্টরপ্রতি এ জাতের ফলন ২৫০০কেজি পর্যন্ত হতে পারে।

খ. ডেভিস : এ জাতটির বীজের সুপ্ততা ও অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা বেশি। তাছাড়া রোগবালাই ও পোকা আক্রামণ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। এ জাতটি বীজ বপনের পর থেকে ১১০-১২০ দিনে পাকে। হেক্টরপ্রতি ফলন ১৮০০ কেজি।

গ. সোহাগ : এ জাতের পরিপক্বতা আসে বপনের পর থেকে ১০০-১১০ দিনে। ফলন হেক্টরপ্রতি ১৫০০-২০০০ কেজি।

৩। জমি তৈরি : সয়াবিনের জমিতে মাটির প্রকারভেদে ৪-৫ টি চাষের প্রয়োজন হয়। মাটি ভালোভাবে চাষ দিয়ে ঝুরঝুরে এবং আগাছামুক্ত করে বীজ বপন করা উচিত। মই দিয়ে জমি সমান করার পর ছোট ছোট প্লট তৈরি করলে পরবর্তীতে জমিতে সেচ দেওয়া, পানি নিষ্কাশন ও অন্তবর্তীকালীন পরিচর্যার সুবিধা।

সয়াবিনের_আধুনিক_চাষ_পদ্ধতি

৪। বীজ বপনের সময় ও পদ্ধতি : রবি ও খরিপ উভয় মৌসুমেই সয়াবিম চাষ করা যায়। রবি মৌসুমে সয়াবিনের বীজ ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত বপন করা ভালো। খরিপ মৌসুমে জুলাই থেকে আগস্ট মাসের মধ্যেই বীজ বপন করা উচিত। সয়াবিন সারিতে বপন করা উত্তম। সারি থেকে সারির দূরত্ব রবি মৌসুমে ৩০ সে. মি. দূরত্বে বীজ  বপন করতে হয়। এভাবে বীজ বুনলে হেক্টরপ্রতি বীজের প্রয়োজন হয় ৫০-৬০ কেজি।

৫। সারের মাত্রা ও প্রয়োগ : জমির উর্বরতার তারতম্যের কারণে এবং কৃষি পরিবেশ অঞ্চলভেদে সারের মাত্রা সাধারণভাবে বিভিন্ন রকম হয়। সয়াবিন চাষের জন্য হেক্টরপ্রতি অনুমোদিত সারের মাত্রা নিচে উল্লেখ করা হলো : ১. ইউরিয়া ৫০-৬০, ২. টি.এস.পি ১৫০-১৭৫, ৩. এমপি ১০০-১২০, ৪. জিপসাম ৮০-১১৫, পচা গোবর বা কম্পোস্ট হেক্টরপ্রতি ২০ টন হারে জমিতে চাষের সময় প্রয়োগ করলে ফলন বৃদ্ধি পায়। সমস্ত সার জমিতে ছিটিয়ে শেষ চাষ ও মই দিয়ে মাটি সমান করে বীজ বপন করা উচিত। সয়াবিনের বীজ বপনের আগে প্রতি কেজি বীজে ২০ গ্রামে ইনোকুলাম (অণুজীব সার) মিশিয়ে বপন করলে গাছের শিকড়ে সহজে নডিউল বা গুটি সৃষ্টি হয়। এতে নাইট্রোজেন সংযোজনের কাজ সহজতর হয়। ফলে ইউরিয়া সার সাধারণত প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না এবং ফলন বেশি পাওয়া যায়।

৬। আগাছা দমন ও চারা পাতলাকরণ : চারা গজাবার ২০-২৫ দিন পর আগাছা দমন করতে হয়। চারা খুব ঘন হয়ে বের হলে নিড়ানি দিয়ে পাতলা করে দিতে হয়। রবি মৌসুমে প্রতি বর্গমিটার ৫০-৬০টি এবং খরিপ মৌসুমে ৪০-৫০টি গাছ রাখা উত্তম।

৭। সেচ প্রদান : রবি মৌসুমে বৃষ্টি না হলে প্রথম সেচ বীজ গজানোর ২০-৩০ দিন পর এবং দ্বিতীয় সেচ ৫০-৫৫ দিন পর প্রয়োগ করতে হয়। গাছের ফল ধরা এবং শুটি গঠনের সময় সম্পূরক সেচ প্রয়োগ করা ভালো।

সয়াবিনের_আধুনিক_চাষ_পদ্ধতি

৮। পোকা দমন : বিছা পোকা ও পাতা মোড়ানো পোকা সয়াবিনের মারাত্মক ক্ষতি করে। বিছা পোকার কিড়াগুলো দলবদ্ধভাবে একত্রে থাকে এবং গাছের পাতার সবুজ অংশ খেয়ে জালের মতো ঝাঝরা করে ফেলে। এ পোকা দমনের জন্য আক্রান্ত পাতা পোকাসহ তুলে আগুনে পোড়াতে হবে অথবা কেরোসিন তেলে ডুবাতে হবে। পাতা মোড়ানো পোকার কিড়া পাতা ভাঁজ করে ভেতরে অবস্থান করে এবং পাতার সবুজ অংশ খায়। এ পোকার আক্রমণ বেশি হলে নগস ১০০ ইসি, এলসান ৫০ ইসি বা মার্শাল ২০ ইসি এর যে কোনো একটি কীটনাশক প্রতি ১ লিটার পানিতে ২ মিলি হারে মিশিয়ে আক্রান্ত গাছে ছিটাতে হয়।

৯। রোগবালাই দমন : সয়াবিন ক্ষেতে মাঝে মধ্যে গাছের গোড়া বা কাণ্ড পচা এবং পাতার হলুদ রোগ বা মোজাইক দেখা দিতে পারে। পাতার হলুদ রোগ বা মোজাইক দেখা দিলে আক্রান্ত গাছটি উঠিয়ে মাটিতে পুতে ফেলতে হয়। রোগটি, বীজবাহিত বলে সুস্থ ও রোগমুক্ত বীজ বপনের মাধ্যমে রোগটি প্রতিরোধ করা যায়। কাণ্ড পচা রোগে আক্রান্ত গাছ আস্তে আস্তে হলুদ হয়ে যায় এবং চারা গাছ শুকিয়ে মারা যায়। গভীরভারে জমি চাষ এবং ফসলের পরিত্যক্ত অংশ, আগাছা ইত্যাদি পরিষ্কার ও পুড়িয়ে এ রোগ দমন করা যায়।

১০। ফসল সংগ্রহ : বীজ বপন থেকে ফসল কাটা পর্যন্ত সয়াবিন ফসলের জন্য ৯০-১২০ ‍দিন সময় লাগে। ফসল পরিপক্ব হলে গাছগুলো শুটিসহ হলুদ হয়ে আসে ও পাতাগুলো ঝরে পড়তে শুরু করে। এ সময়  ফলের রং খয়েরি বর্ণের হয়। মাটির সাথে মোথা রেখে গোড়া থেকে গাছ কেটে ২-১ দিন রোদে শুকিয়ে লাঠি দিয়ে আস্তে আস্তে পিটিয়ে দানাগুলো আলাদা করা যায়।

১১। বীজ সংরক্ষণ : সয়াবিন বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা বেশি দিন বজায় থাকে না। তাই বীজ এক নাগাড়ে ৩-৪ ঘণ্টায় বেশি রোদে রাখা ঠিক নয়। বীজ এমনভাবে শুকাতে হয় যাতে বীজে আর্দ্রতা ১০-১২% এর বেশি না থাকে। বীজ রাখার জন্য পলিথিনের ব্যাগ, টিনের ড্রাম, আলকাতরা মাখা মাটির মটকা বা কলসি, বিস্কুটের টিন ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে। বীজের আর্দ্রতা কমানোর জন্য মাঝেমধ্যে রৌদ্রে দিতে হবে।

১২। ফলন : সাধারণত মৌসুম ও এলাকাভেদে সয়াবিনের হেক্টরপ্রতি ১৫০০-২০০০ কেজি ফলন পাওয়া যায়।

এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পূর্ন বেআইনী এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। হিমেল/বিডি দিগন্ত


এ জাতীয় আরো সংবাদ